প্রবন্ধটি লিখেছেন আইরিশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী জেমস কনোলি, যিনি ১৯১৬ সালের ইস্টার রাইজিংয়ে তাঁর ভূমিকার জন্য ব্রিটিশদের হাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। এখানে কনোলি ধর্ম এবং সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় লেখক কর্তৃক সম্পাদিত ‘ওয়ার্কার্স রিপাবলিক’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায়, ১৭ জুন ১৮৯৯ তারিখে। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করা হলো।
সমাজতন্ত্রের নীতিগুলোকে কেন্দ্র করে ধর্মের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়ে যতটা ভুল বোঝা হয়েছে সম্ভবত অন্য কিছু নিয়ে এত ভুল বোঝা হয়নি অথবা এত ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অর্থনীতি, রাজনীতি অথবা নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রবিরোধীরা বিতর্কে পরাজিত হলে; ধর্মের প্রশ্নটি তার শেষ হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় অবশ্যম্ভাবীভাবে, বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে।
পুঁজিবাদের সমর্থকদের এই হয় শেষ কৌশল যে “কিন্তু সমাজতন্ত্র তো ধর্মবিরোধী”, অন্য সব কথা বা তর্কে যখন তারা আর পেরে উঠে না কিংবা পরাস্ত হয় তখন এই কথাই হয়ে উঠে তাদের শেষ কথা। “সমাজতন্ত্র মানেই নাস্তিক্যবাদ, আর সব সমাজতন্ত্রীই নাস্তিক” অথবা “গির্জার ওপর হামলার জন্য নাস্তিক্যবাদকে আড়াল করার এটি একটি সুন্দর নাম”, এই ধরণের কথা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের ভালো-মন্দ পর্যালোচনার চেয়ে বিতর্কগুলোতে বেশি উঠে আসে। এই প্রকারের বিষয়গুলো অনেক বেশি করে আনা হয় যেগুলোর এখানে উল্লেখ করার কোনো দরকার নেই, বরং এদের অযৌক্তিকতা বোঝানোর জন্য শুধুমাত্র উল্লেখ করা হলো।
সমাজতন্ত্রকে নাস্তিকতার সমার্থক ভাবা শুধু ভুলই নয়, তথ্যবিরুদ্ধও। আমাদের এই প্রজন্মে মুক্তচিন্তার (Freethought) প্রায় সকল বিশিষ্ট মুক্তমনাই সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং এখনও অনেকেই আছেন। প্রয়াত চার্লস ব্র্যাডলফ (Charles Bradlaugh) যিনি কিনা তাঁর সময়ে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক মুক্তমনা ছিলেন, সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর ঘৃণা-বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত কঠোর এবং আপসহীন ছিল।ইংরেজি ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার জাতীয় মুখপত্র ফ্রিথিঙ্কারের বর্তমান সম্পাদক জি.ডব্লিউ. ফুট (G.W. Foote), তিনিও সমাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধিতাকারী। আর প্রয়াত কর্নেল বব ইনগারসোল (Colonel Bob Ingersoll), যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তচিন্তার মতবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন, তিনিও পুঁজিবাদের একজন সমর্থক হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন।ইউরোপ মহাদেশে এ ধরনের আরও বহু অনুরূপ উদাহরণ টানা যেতে পারে, কিন্তু পাঠকদের সহজে যাচাইযোগ্য করার জন্য পূর্বে উদ্ধৃত ঘটনাগুলিই যথেষ্ট। এটি এক অর্থে শিক্ষণীয় এবং এক অর্থে রসিকতার মতো একটি বাস্তবতা যে পুঁজিবাদের রঙ-বেরঙের রক্ষকদের সারিতে মুক্তচিন্তার পেশাদার প্রচারকেরা দাঁড়িয়ে আছেন মহামান্য পোপের সহযোদ্ধা হিসেবে। সম্প্রতি সমাজতন্ত্রবিরোধী যে দুর্বল যুক্তির, সিদ্ধান্তহীন এনসাইক্লিকালস (পোপের ধর্মীয় নির্দেশ) জারি হয়েছে, তা ক্যাথলিক চার্চের ধর্মীয় নেতৃত্বকে পরিণত করছে সেইসব বাহিনীর পিছনে চলা বিলম্বিত অনুগামীতে, যে বাহিনী ব্যক্তিবাদী দর্শনের নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী প্রচারকদের পতাকা উত্তোলন করে চলেছে।এটা তো স্পষ্ট যে অতি সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষও বুঝতে পারে যে একজন মুক্তমনা হিসেবে মুক্তচিন্তকের ভাবনা আর একজন সমাজতন্ত্রী হিসেবে সমাজতন্ত্রীর ভাবনার মধ্যে কোনও বাধ্যতামূলক মিল থাকাটা জরুরি নয়।তাহলে এসব প্রচলিত বিতর্কের উৎস কোথায়? প্রথমত, ধনিক শ্রেণির সচেতন প্রচেষ্টা, যাতে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এমন এক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করা যায় যাতে শ্রমজীবী মানুষেরা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রতি মনোযোগ দিতে নিরুত্সাহিত হয় এবং দুঃখজনকভাবে, এই প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়। দ্বিতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক পার্টির সামগ্রিকভাবে ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্নে যে অবস্থান তা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভুল ধারণা।আয়ারল্যান্ডের সমাজতান্ত্রিক পার্টি জনসভা হোক বা অভ্যন্তরীণ বৈঠক সর্বক্ষেত্রেই ধর্মতাত্ত্বিক বা ধর্মবিরোধী আলোচনাকে নিষিদ্ধ করে। এটি বিশ্বের প্রধান সমাজতান্ত্রিক পার্টিগুলোর সাধারণ রীতি অনুসরণ করে; যেমন জার্মানিতে বহুবার ঘোষণা করা হয়েছে যে ধর্ম হল যার যার ব্যক্তিগত বিষয়, এবং এটি পার্টির কর্মসূচির (সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির) বাইরে।আধুনিক সমাজতন্ত্র তার স্বভাবগতভাবে এক বাস্তবভিত্তিক, অভিজ্ঞতানির্ভর মতবাদ। বলতে চাই না যে সব সমাজতন্ত্রী নাস্তিক বা বস্তুবাদী; বরং দল হিসেবে তারা কোনো ধর্মগ্রন্থ, কোন দেবতার অনুমানকৃত ইচ্ছা বা কোনো ধর্মীয় ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে অবস্থান নেয় না। সদস্যদের ধর্মবিশ্বাস সম্পূর্ণই তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।আজকের দিনে আমাদের মধ্যে কার্যকর সামাজিক জীবনের বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে বা ইতিহাসের লিপিবদ্ধ তথ্যগুলিতে যেমনটি খুঁজে পাওয়া যায়, একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে বিচক্ষণতার সঙ্গে সেটির উপর অবস্থান নিতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।যদি ধর্মগ্রন্থের কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা সমাজতন্ত্রের দিকে মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে, বা কখনও কখনও ধর্মীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ধারণার মিল পাওয়া যায়, তবে একজন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী মাত্রই মনে করেন যে এই ব্যাখ্যাটি সমাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করে না; বরং সমাজতন্ত্র শক্তিশালী বলেই সে এসব মিলগুলোকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। কিন্তু তিনি অগত্যা সেইটা বিশ্বাস করতে যান না যে তাঁর ধর্মতাত্ত্বিক মিত্রের কারণে সমাজতন্ত্র আরো শক্তিশালী বা এর অবস্থান আরো দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবে।বরঞ্চ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস যে বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা অনেক যথেষ্ট শক্তিশালী, যে কোনো আঘাত বা বিরোধিতার মোকাবেলা করতে সক্ষম। তাই বাহির থেকে সাহায্য পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করতে তার আপত্তি নেই কিন্তু শর্ত একটাই, সেই সাহায্য গ্রহণের বিনিময়ে তাকে যেন এমন কোনো মতবাদ বা শক্তির সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে একীভূত করতে বাধ্য না করা হয়, যার পতন সমাজতন্ত্রকেও বিপন্ন করে দিবে। সমাজতন্ত্রীরা কেন ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদ বা ধর্মের ক্ষেত্র থেকে দুরন্ত বজায় রাখার চেষ্টা করে এটি হলো তার প্রধান কারন। কারণ আমরা মনে করি, সমাজতন্ত্র এমন একগুচ্ছ বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ায়, যা বুঝতে মানুষের নিখাদ যুক্তিবুদ্ধি ছাড়া আর কোনকিছুর দরকার নেই, যেখানে প্রতিটি ধর্মই অতীতের কোনো এক সময়ে এমন একগুচ্ছ ঘটনার উপর ‘বিশ্বাস’-এর উপর প্রতিষ্ঠিত যা নিছক মানব যুক্তির কোনো প্রক্রিয়া দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না; যেখানে প্রতিটি ধর্ম স্বীকার্যভাবে অতীত যুগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিতে ‘বিশ্বাস’ এর উপর ভিত্তি করে।অতএব, সমাজতন্ত্রকে ধর্মের সঙ্গে একীভূত করা মানে হবে সেই সর্বজনীন, অসম্প্রদায়িক চরিত্রটির বিসর্জন দেয়া, যে অসম্প্রদায়িক চরিত্রটি শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের জন্য আজ একান্ত প্রয়োজনীয়।কারণ অসম্প্রদায়িক চরিত্রটি ত্যাগ করার মানে হবে আমাদের সদস্যদেরকে একদিকে নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবাদে দীক্ষিত কিংবা অন্যকোন অর্থনৈতিক বিশ্বাসে বাধ্য করানো— যে পথে হাঁটার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমাদের নেই। সেই পথ আমাদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর চিরন্তন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ফেলবে এবং শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক পার্টিকে ভাঙনের দিকে নিয়ে যাবে।
সমাজতন্ত্র, দল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে তথ্য, ইতিহাস এবং অর্থনীতির চরম বাস্তবতার ওপর; আর ধর্মীয় আদর্শ বা বিশ্বাস ধারণ করার কাজটি সে জনসাধারণের ওপর (অথবা সদস্যরা চাইলে তাদের ব্যক্তিগত বিবেকের ওপর) ছেড়ে দেয়। এটি (সমাজতন্ত্র) না শুধু মুক্তমনাদের , না খ্রিস্টানদের ; না তুর্কীদের , না ইহুদিদের ; না বৌদ্ধদের , না মূর্তিপূজকদের ; না মুসলমানদের , না পার্সিদের —এটি কেবলমাত্রই গণমানুষের মতবাদ।
অনুবাদঃ শাখাওয়াত হোসেন রুদ্র
